অপেক্ষা - মাহা আরাত

হাফসার সারাদিন মন খারাপের সাথে পার হলো।অন্যদিন বাইরে থাকলে কল না করলেও একটা টেক্সট করতেন।
কিন্তু আজ কোনো টেক্সটই আসলো না।সেই সাতসকালে বেরিয়ে গেছেন।নাস্তা করেছেন?লাঞ্চ করেছেন?আরো কত প্রশ্নই আসে হাফসার মনে।কাজের চাপ থাকলে করবেন না।এক কাপ কফি খেয়েই দিন কাটিয়ে দিবেন!

________
মাগরিবের নামাজ পড়ে আরহাম ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ঢুকলেন।ঘুম না হলে প্রচন্ড রকমের মাথাব্যথা করা উনার নিয়মকার ঘটনা!
হাফসা সবাইকে চা পরিবেশন করছিলো।আরহাম সোজাসুজি উপরে চলে গেলেন।আম্মু কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন, কিছু খাবেন কী না।উনি শুধু না বোধক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন।

সবাইকে সন্ধ্যার নাস্তা পরিবেশন করে হাফসা যখন আরহামের রুমে গেলো তখন দেখলো উনার রুমের লাইট অফ।ওয়াশরুম থেকে এখনো পানির টুপটাপ আওয়াজ আসছে।ড্রীম লাইটের আধো আলোয় দেখা যাচ্ছে উনি শুয়ে আছেন।এসে শাওয়ার নিয়েই কি ঘুমিয়ে গেলেন? হয়তো বা!সারাদিনের ক্লান্তি তো!

________
আরহামের ঘুম ভাঙ্গলো দশটার পর।একসাথে ইশার নামাজসহ তিলাওয়াত করে যখন নিচে নামলেন আম্মু ডিনার বেড়ে দিলেন।

‘সবার খাওয়া শেষ?’

‘আমাদের খাওয়া শেষ।মাইমুনা আগে খেয়ে নিয়েছে। হাফসা খায়নি।’

‘কেন?’

‘বললো ইচ্ছে করছে না।সাহারিতে উঠে খেয়ে নিবে।’

‘খাবারে অনিয়ম করে অসুস্থ হলে?’

‘আমি আরেকবার গিয়েছি।দেখে আসলাম ও ঘুমাচ্ছে। তাই আর ডাকিনি।’

আরহাম কিছু বললেন না।একা একাই ডিনারে সেরে যখন রুমে আসলেন দেখলেন হাফসা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।পাশে গিয়ে বসতেই কেমন যেনো গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পেলেন।মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন হাফসার পুরো শরীর গরম।জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।আরহাম আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন থার্মোমিটার দিয়ে হাফসার জ্বর মেপে।উচ্চ লেভেলে আছে জ্বর।

(৬১)

ঘড়িতে ১২ টার ঘর পেরিয়েছে সেই কবেই।
আরহাম ওর মাথার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। হাফসা একহাত দিয়ে আরহামের হাতটা ধরে আছে।গাঢ়ী তিনটে ব্ল্যাঙ্কেট দেওয়ার পরও আরহাম হাফসার কাঁপুনি বুঝতে পারছেন।শুভ্র মুখখানা লাল হয়ে আছে।গরম নিঃশ্বাস পড়ছে আরহামের গালে, কপালে।হাফসার দিকে খানিকটা ঝুঁকে কপালে চুমু দিলেন।

হঠাৎ অনুভব করলেন হাফসা কিছু বলছে।

আরহাম ওর মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে লাগলেন।
আধো আধো বুলিতে বিড়বিড় করছে, ‘দূর্বলদের সবাই আঘাত করতে ভালোবাসে তাই না!কথাটি কেমন জানি আমার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।’

আরহাম ভেতরে ভেতরে খুবই অপরাধবোধে ভুগলেন। হাফসার হাতের ভেতর দিয়ে যেন গরম উল্কা এসে ডুকছে আরহামের হাতের মুষ্ঠিতে।

বেশ কিছুক্ষণ চলে গেল।হাফসা হঠাৎ আবার ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,

‘কিন্তু আপনি আমাকে দূঃখ দিলেন।আমাকে কেউ কখনো কঠিন কথা বলে নি এর আগে।আপনার কথাগুলো বিষের চাইতেও বিষাক্ত মনে হয়।আপু আমার মা বাবাকে নিয়ে অনেক কঠিন কিছু কথা বলেছিলেন আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।আর উনি আপুকে খুব বিশ্বাস করেন।কিছু কিছু ইন্সিডেন্ট যে ঘটে গেলো আপুর বানানো কথা বিশ্বাস করে নিলেন।আপু যা বলতেন ওটা শুনেই আমাকে কথা বলতেন।আমার মা-বাবা নেই তো।আমি দূর্বল তাই সবাই এমন বলে তাই না?’

কথাগুলো অনেকক্ষণ নিয়ে ভাঙা ভাঙ্গা বুলিতে আওড়ালো হাফসা।আরহামের চোখ টলমল করছে।এত কষ্ট দিলাম আপনাকে?

আরহাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ক্ষমা করেছেন তাকে?’

হাফসা বেঘোরে জবাব দিল, ‘কারো কোনো অপরাধ অভিযোগ আমি মনে পুষে রাখি না।আমার তরফ থেকে সবাইকে মাফ।কিন্তু দূঃখ লাগে।আমার আগের জীবনটা খুব সুন্দর ছিলো।ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম ছিলো না।আমি আমার মতো ছিলাম।’

‘কথা বলেন না কেন আমার সাথে?আমাকে ইগনোর করেন কেন?’

32★

‘কথা বলেন না কেন আমার সাথে?আমাকে ইগনোর করেন কেন?’

ওর আধোবুলির বাক্যগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে।হাফসা পুরোপুরি নিজের মধ্যে নেই।জ্বরের ঘোরে বলছে।তাই আরহাম জিজ্ঞেস করলেন,
‘আমার প্রতি কি রাগ আছে?আমাকে ঘৃণা করেন?’

হাফসার আরো কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না।ঘুমিয়ে গিয়েছে হয়তো।আরহামের বাহুডোর ধরে রেখেছে একহাতে।

আরহাম ওর হাতের শক্ত বাঁধনটা ছাড়িয়ে নিলেন।মাথায় নতুন করে জলপট্টি দিয়ে দরজা লক করে হাফসার পাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে ওকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে রইলেন।হাফসা ঘুমোচ্ছে।হাফসার শরীরের তাপে আরহাম ঘামতে লাগলেন।বুকের মাঝে যত্ন করে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ।সারা মুখে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলেন।খুব কষ্ট হচ্ছে উমায়ের এর কষ্ট দেখে।আল্লাহ যেনো তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেন হোমাপাখিকে!

_________
আজ প্রথম সাহরি।তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে।হালকা গর্জন হচ্ছে মেঘের।

কারেন্ট নেই।জেনারেটর কাজ করছে না।ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালানোর মতো চার্জ ও নেই।ক্যান্ডেল জ্বালানো হয়েছে ডাইনিং এ।নিচে সবাই ওয়েট করছেন।

আরহাম হাফসার গালে আলতো চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উমায়ের!’

বেশ কয়েকবার ডাকার পর হাফসা চোখ কুঁচকে তাকালো।জ্বর কম শতাংশ কমেছে।হাফসা অনুভব করলো,বৃষ্টিস্মাত রাতের তীব্র শীত এড়াতে জায়গাটা যেনো একেবারে উষ্ণ, আরামদায়ক।প্রশস্ত গরম কিছুর সাথে লেগে আছে।আরহাম বা হাতে ফোন জ্বালাতেই হাফসা চোখ খুলে।এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এটা কোন জায়গা।মস্তিষ্ক বুঝতে ব্যর্থ হলো।মুখ উঁচিয়ে ওপরে তাকাতেই আরহামকে নিজের এতোটা কাছে দেখে হকচকিয়ে গেলো।কত শক্ত করে ধরে আছে মানুষটাকে।

আরহাম ওর মাথার টেম্পারেচার চেক করলেন।হাফসা এখনো হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে উনার দিকেই তাকিয়ে আছে।

‘জ্বর তো কমেনি।সাহরির সময় হয়েছে।নিচে যেতে পারবেন?না আমি এখানে নিয়ে আসব খাবার?’

‘খাবো না।’

‘তাহলে রোযা রাখবেন কী করে?’

‘পারবো।’

আরহাম ওকে বিছানায় বসালেন।ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল ভিজিয়ে এনে চোখমুখ মুছিয়ে দিলেন।একটা হিজাব এনে পরিয়ে কোলে তুলে নিলেন।

হাফসা দূর্বল গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি?হাতে পায়ে শক্তি পাচ্ছি না কেনো?’

‘বেশী দূর্বল আপনি।’

আরহাম ফ্ল্যাশের আলোয় নিচে নামলে আম্মু এসে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে হাফসার?’

‘প্রচন্ড জ্বর ছিলো রাতে।এখন একটু কম লাগছিলো কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে আবার।’

‘তাহলে নিয়ে আসলে কেন?ওপরে নিয়ে খাইয়ে দিতাম।’

‘আমি ধরে খাওয়াবো।খাওয়া শুরু করুন।’

আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার চোখ এত লাল কেন?’

‘ঘুমাইনি।’

আরহাম হাফসাকে উনার পাশে বসালেন।

মাইমুনা তাকিয়ে আছে দূজনের দিকে। আরহাম গতদিন ওই কথাগুলো বলে যাওয়ার পর খুব কেঁদেছে।আরহাম ওকে আর বিশ্বাস করবেন না।আরহামের কাছে ছোট হয়ে গিয়েছে,ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

মোমবাতির ধেঁয়ে ওঠা আলোয় আরহাম মাইমুনাকে দেখছিলেন।চোখে চোখ পরতেই বললেন, ‘সরি খাইয়ে দিতে পারছি না আপনাকে।আমি তো দূরে।’

মাইমুনা তড়িঘড়ি করে বলল, ‘জ্বি না সমস্যা নেই আমি খেয়ে নিতে পারবো।’

একপ্রকার জোর করে মাএ তিন লোকমা খাইয়েছেন হাফসাকে।আর খেতে চাইছে না দেখে আরহাম ফ্রুটস আনিয়ে খাওয়ালেন।ফ্রুটস ও কোনোপ্রকার খেলো না,শুধু কয়েক টুকরো অরেন্জ।খাইয়ে প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলেন।হাফসার খুব অস্বস্তি হচ্ছে সেই কখন থেকে।মাথা ঘুরছে।ভেতর থেকে সব যেন গুলিয়ে আসছে।আরহামের বাহুতেই হেলান দিয়ে আছে।আর মিনিট পাঁচেক আছে সাহরির টাইম।আরহাম যেইমাএ খাওয়া শুরু করবেন অমনি হাফসা মুখে হাত চেপে রয়।একহাত দিয়ে আরহামের বুকের শার্ট খামচে ধরে।আরহাম ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’
হাফসা ইশারায় কিছু একটা বুঝাচ্ছে বারবার তবু মুখ খুলছে না।

তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘বলুন কি হয়েছে?আমি বুঝতে পারছি না।অস্বস্তি হচ্ছে?

আরহাম ওর স্পর্শে থাকায় বুঝতে পারছেন জ্বর আবারও বেড়েছে।হাফসা কিছু বলার চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না।যেই মুখ খুললো অমনি গড়গড় করে আরহামের ওপর বমি করে দেয়।নাকে মুখে বিষম উঠে গেলো।

আম্মু এগিয়ে এসে পিঠে মাসাজ করে দিতে লাগলেন।লাল চোখেমুখ,গরম নিঃশ্বাস পড়ছে, হাত পা কাঁপছে হাফসার।আরহাম কে বেশ ভালোই ভরিয়ে দিয়েছে। অসহায় চোখে একবার তাকাতেই আরহাম ওকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ইটস ওকে।বেশি খারাপ লাগছে উমায়ের?ডক্টর নিয়ে আসি?’

আরো একবার বমিটিং হলো।আরহাম,আম্মু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওকে নিয়ে।ততক্ষণে এলার্ম বেজে উঠলো,
সাহরির সময় শেষ!

‘তুমার খাওয়া হলো না।’

‘সমস্যা নেই আম্মু।আমি পারবো।বাট উনি….’

‘চিন্তা করো না।তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।’

আরহাম চলে গেলেন।আব্বু এসে বললেন, ‘আমি কি ডক্টর কল করব?হাফসা তো বেশি অসুস্থ।’

আম্মু উত্তরে বললেন, ‘আপাতত ঘুমিয়ে নিক।যখন উঠবে তখন ডক্টর এসে দেখে যাবে।’

______
আরহাম ওকে নিয়ে আসছেন রুমে।রীতিমতো নিজেও কাঁপছেন গোসল করায়!
হাফসা কে গরম পানি দিয়ে অযু করিয়ে নামাজ পড়িয়ে নিজেও নামাজ পড়ে নিলেন।তারপর আগের মতো আবারও বুকের ওপর জড়িয়ে ধরে রাখলেন।সে পিটপিট করে কয়েকবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ বুজে নিলো।এরইমাঝে শুরু হলো তুমুল বজ্রধ্বনি।প্রতিটা গর্জনে যেন আকাশ কাঁপিয়ে তুলছে।আচমকা গর্জন উঠতেই দিতেই হাফসা শক্ত করে চেপে ধরলো আরহাম কে। আরহাম ভয় পাচ্ছেন।নিজের শরীরের সাথে একেবারে মিশে থাকায় হাফসার কাঁপুনি টের পাচ্ছেন।ইতিমধ্যে ঘামতেও শুরু করে দিয়েছেন তাহলে কি প্যানিক আ্যটাক হতে পারে!

এসব ভাবতেই একরাশ ভয় এসে ভীড় করলো মনের মধ্যে।অসময়ে চোখটাও জ্বলছে ঘুম না হওয়ার জন্য। আরহাম ওর কপালে গালে একনাগাড়ে কয়েকটা চুমু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওপরে ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিলেন।বৃষ্টির বেগও কমছে না।শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে।যদিও গায়ে গরম কাপড় প্রয়োজন এই ঠান্ডায়!তবে তার প্রয়োজন নেই কারণ হাফসার জ্বরে পোড়া গরম দেহ-ই আরহাম কে উষ্ণতা দিচ্ছে।এরইমধ্যে আম্মু একবার এসে খোঁজ নিয়ে গেছেন।

কেটে গেলো আরো কিছুক্ষণ।আরহাম একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ওর টুকটুকে লালবর্ণ ধারন করা মুখাবয়বে।এত মায়া!এত মায়া কেন আপনার চেহারায়!এমন পরিস্থিতিতেও আরহামের অন্য রকম একটা শান্তি অনুভূত হচ্ছে কারণ উনার হৃদয়ের অংশটা হৃদয় সংলগ্নেই।মনে মনে আওড়ালেন, ‘আপনি কাছে থাকলেই আমার শান্তি।’

নিদ্রাহীন চোখগুলো তন্দ্রায় তলিয়ে যাচ্ছে।শেষ একবার কপালে গাঢ় চুমু দিয়ে বিছানার বেডশীটে মাথা লাগিয়ে দিলেন আরহাম।

(৬২)
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন নিজেকে আবিস্কার করলো আরহামের বুকের মাঝে দূ’হাতের বন্ধনে।উনি বেডশিটে মাথা লাগিয়ে ঘুমুচ্ছেন।ব্ল্যাঙ্কেটের ভেতর থেকে মুখ বের করলো হাফসা। অবাক হলো ভীষণ আরহাম এভাবে ওকে ধরে রাখতে দেখে।উনার বুকের ওপরেই ঘুমিয়েছে।আর ওপরে এত কাঁথা কেন?উফফ গরম লাগছে।

হাফসা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয় আরহামের ঘুমন্ত চেহারার দিকে।কাছ থেকে এভাবে কখনো দেখা হয় নি।চোখ ধাঁধানো সুন্দর!লোকটা কি দিন দিন ইয়াং আর সুদর্শন হচ্ছে নাকি!

হাফসা বের হয়ে উঠে বসে।নড়াচড়ায় আরহামের ঘুম হালকা হয়ে এলো।চোখে মুখে হাত বুলিয়ে একটু সময় নিয়ে পিটপিট করে চোখ তুলে তাকালেন।

হাফসাকে দেখতেই তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
অতপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি বিছানায় কেন?আমার বুকে না ঘুমিয়ে ছিলেন?’

‘এইমাএ সরেছি।’

‘ওহহ।’

আরহাম এগিয়ে ওর মাথার টেম্পারেচার মেপে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

হাফসা শুধু অবাক হচ্ছে।ওর কি জ্বর আসছে না কি যে মাথায় হাত দিতে হবে।নিজে নিজের মাথায়ই হাত দিয়ে দেখলো।কই ঠান্ডা তো!কোনো জ্বর নেই।

আরহাম ততক্ষণে উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছেন।হাফসা ও ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম গেলো।উনি মেসওয়াক করছেন।ব্রাশ টা হাতে তুলে নিলো হাফসা।বড় আয়না সামনে। ব্রাশ করতে করতে আড়চোখে দেখলো আরহাম ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।

_______
‘খিদে লেগেছে?’

‘উহু।’

‘রোযা রাখতে পারবেন তো?’

‘রোযা?’

আরহাম হেসে ফেললেন।টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উনার রুমের দিকে চলে গেলেন।

_______
‘আম্মু আসব?’

‘মায়ের রুমে আসতে পারমিশন লাগে?আসো।’

হাফসা কাছে যেতেই আম্মু ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘জ্বর কমেছে?’

‘কিসের জ্বর?’

‘মনে নেই তোমার?কাল প্রচুর জ্বর ছিলো তুমার।’

‘পরে কি হলো?’

‘তারপর…

তাদের কথার মধ্যেই আরহাম এসে বললেন, ‘আম্মু আমি বেরোচ্ছি।’
হাফসাকেও বিদায় জানিয়ে সালাম দিয়ে আরহাম চলে গেলেন।

হাফসার আরহামের দিকে কোনো ধ্যান নেই।উনি যেতেই হাফসা প্রশ্ন করলো, ‘বলুন কি হলো তারপর?’

‘আরহাম ঘুমায়নি সারারাত।সাহরিতে তোমাকে কোলে করে নিয়ে আসলো।অল্প খেয়ে তো বমি করলে ওর ওপরই।আরহাম আর খায় নি।সাহরির সময় শেষ হয়ে গেছিলো।’

হাফসার এসব কিছুই মনে পড়ছে না।উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, ‘তারপর?’

‘তার আর পর নেই।আমি অবশ্য খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম দেখলাম তোমাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।’

_______
সারাটাদিন শত প্রশ্ন মাথায় ভরে রেখেছে।আরহাম আসলে জিজ্ঞেস করবে।উনি অবশ্য ফোন দিয়েছিলেন।তিনবারই ফোন দিয়ে সেইম প্রশ্ন করেছেন, ‘খিদে লেগেছে?কষ্ট হচ্ছে রোযা রাখতে?’

হাফসার খারাপ লেগেছে।ওর জন্য আরহাম সাহরি খাননি।এত কেয়ার করেছেন!

________
সময়টা বিকেলের শেষ প্রান্তে।কাকামণির সাথে মাএ কথা শেষ হলো।আজকে ইফতারের স্পেশাল আয়োজন।আযানের আর কিছুসময় বাকি।হাফসা চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে দরজার পানে।আজকেও কি উনি লেট করবেন?

হাফসার ভাবনার সুতো কাটলো যখন কলিং বেল বাজলো।উনার ক্লান্তশ্রান্ত মুখশ্রী হাফসার হৃদয়ে কাটার মতো ফুটলো যেন।আশ্চর্য! আজ এতো মায়া হচ্ছে কেন উনার উপর!

আরহাম নিচের ওয়াশরুম থেকেই ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসলেন।হাফসার পাশের চেয়ারে বসে হাফসার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলেন।

________
ইফতারের আগ-মুহুর্তে দোয়া শেষে ‘আল্লাহ আকবার’ আযানের ধ্বনিতে সবাই খেজুর মুখে নিলো।আরহাম প্রথম খেজুরটা মাকে খাইয়ে দিলেন।তারপর বাকিদের।

___________
ইফতার শেষে রুমে এসে নামাজ পড়ে আবার কিচেনে গেলো হাফসা।মাকে টুকটাক হেল্প করতে বেশ অনেকক্ষণ সময় চলে গেলো।মা অবশ্য মানা করেছিলেন কিছু করা লাগবে না।কিন্তু হাফসার বিবেকে বাঁধলো।সাহরির এতো রান্না মা একা করবেন।আব্বু আর উনি তো মায়ের হাতের রান্না ছাড়া খান না।আম্মুর বেশী কষ্ট হয়ে যায়।তাই সাহায্য করতে গিয়ে পড়লো ইশার আযান।

একটু ফাঁক পেয়ে হাফসা আসলো ওপরে।সেই কখন থেকে ভাবছে আরহামকে প্রশ্নটা করেই ছাড়বে।
আরহামের রুমের সামনে আসতেই দেখলো আরহাম শেমাক জুব্বা পড়ে রেডি।টেবিলে ল্যাপটপে অ্যারাবিক কিছু একটা দেখেছিলেন।হাফসাকে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলেন।

‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন?আসুন ভিতরে।আমার রুমে আসতে আর কখনো পারমিশন নিবেন না কতবার বলতে হবে।’

‘কো্ কোথায় যাবেন?’

‘তারাবীহ তে।’

‘বাসার পাশের মসজিদে তো আযান হয়নি এখানে।’

‘এখানে না।একটু দূর একটা মসজিদে তারাবীহ পড়াবো।কিছু বলবেন?’

হাফসা মাথা দূপাশ নাড়ালো।এভাবে তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করতে চায় না।কিছু সময় দরকার।

‘নিশ্চয়ই কোনো দরকারে আসছেন।বলুন কী জন্য আসছেন?’

‘তেমন কিছু না।নিচে যাচ্ছি।’

‘ওয়েট।’

আরহাম ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ফোন টা হাতে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসেই কপালে একটা চুমু দিলেন।

‘আসি।নামাজ পড়ে নিন।টাইমলি।’

হাফসা যখন নিচে আসলো দেখলো বাবা-ছেলে দূজনে সেইমম পান্জাবি সেইম কালার পাগড়ি পড়ে আঁতর মেখে বেরোচ্ছেন।এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে অজান্তেই হাফসার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।আরহাম চোখের ইশারায় হাফসাকে আবার বিদায় দিয়ে দূজনে বেরিয়ে গেলেন।

******
ঘড়ির কাটায় সাড়ে ন’টা পেরিয়েছে।তারাবীহ শেষে কুরআন তিলাওয়াত করে উঠলো।নিচে আম্মু, মাইমুনা, আর হাফসা একসাথে তারাবীহ পড়েছে।

আরহাম,আব্বু আসলেন।তারপর শুরু হলো তালিম।

তালিম শেষে খোশালাপ হলো কিছুক্ষণ।আরহাম চলে গেলেন রুমে। হাফসাও পিছুপিছু যায়।

(৬৩)
রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘গতরাতে আমি আপনাকে কি কি বলেছি?’

আরহাম জুব্বা খুলে শার্টের গোতাম লাগাচ্ছিলেন।হাফসার প্রশ্ন শুনে হাত থেমে গেলো।

কিছুক্ষণ পার হলো।উনি উত্তর দিলেন না।শুধু তাকিয়ে রইলেন।

হাফসা আবারও গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন কি বলেছি আমি?’

আরহাম গা ছাড়া ভাব নিয়ে মাথা দূপাশ দূলিয়ে বললেন, ‘বলা যাবে না।সিক্রেট।’

হাফসা হাল ছেড়ে দিলো।শুধু শুধু কথা বাড়াতে চাইছে না।কিছুসময় চুপ থেকে বলল, ‘রাতে যা বলেছি।জ্বরের ঘোরে বলেছি।আবোলতাবোল বলেছি।বিশ্বাস করবেন না কিছু।’

‘আমি তো করেছি।’

‘জ্বরের ঘোরে বলেছি তো।’–কিছুটা জোর দিয়ে কথাটি বলল।

‘তবুও আমি বিশ্বাস করেছি।’

‘মিথ্যে বলেছি তাহলে বিশ্বাস করবেন কেন?’

‘আপনি জ্বরের ঘোরেও মিথ্যে বলেন না।’

নিজের প্রতি নিজেরই রাগ হলো হাফসার।আরহামের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।চেপে রাখা ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।ভেতরে শ্বাস ভারি হয়ে আসছে।কান্না আসছে কেন?এখানে কান্নার কি হলো!নিজেকে নিজেই মনে মনে বকতে লাগলো।এই টপিকটার কথা মনে হলেই নিজের অজান্তেই কান্না চলে আসে।আরহামের বলা একটা কথা কানে বাজতে থাকে ‘আপনি আমার মাসনা হওয়ার যোগ্য না’।নাক টেনে হেঁচকি উঠতেই হাফসা সরে গেল।উনার সামনে কান্নার কোনো মানে হয় না।উল্টো ঘুরে হাতের পিঠ দিয়ে সদ্য গালে বেয়ে পড়া পানি মুছতে নিলেই কেউ সামনে আসলেন।কোনোকিছুর বোঝার আগেই শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

2025 © Golpo Hub. All rights reserved.