“ভালোবাসি” শব্দটা উচ্চারন করার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাম গালে শক্তপোক্ত এক চ*ড় বসালেন ধূসর ভাই। কান,মাথা,গাল ঝিমঝিম করে উঠল আমার। ভোঁ ভোঁ করে ঘুরল সমগ্র পৃথিবী। হতবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। ধূসর ভাইয়ার র*ক্তাভ চোখদুটো আমাতেই নিবদ্ধ। ক্রো*ধে ফুঁ*সছে তার চোখা নাক। এই আঠের বছরের জীবনে কোনওদিন মা*র না খাওয়া আমি, আজ যেন কথা বলার
আ*হত হলাম। ধূসর ভাই খুঁজে খুঁজে ওষুধের একটা পাতা বের করলেন। সেখানে থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ” খা।”
সারাটা কলেজ আমি রবিনকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ক্লাশেতো পাই-ইনি,এমনকি ফোনেও না। গত কাল ধরে লাগাতার ফোন দিয়েছি অথচ ছেলেটা ধরেনি। সেই যে শেষবার পালাতে বললাম তারপর আর না। ধূসর ভাই ওকে পেলেন কী না,ওর সাথে দেখা হলো কী না,কী কী বললেন, এসব জানার জন্যে আমার ভেতরটা আঁকুপাঁকু করছিল। ধূসর
”তুই?” এই সামান্য দুই শব্দের বাক্যটা ধূসর ভাই এমন ধ*মকে শুধালেন,আরেকটু হলেই প্রানপাখিটা উড়ে যাচ্ছিল প্রায়। গত তিনবছর ধরে ধূসর ভাইয়ের রামধম*ক খেয়ে পরে বেচে আছি। হিসেব মতো এ আমার কাছে ডালভাত হওয়ার কথা। অথচ প্রতিটা বার আমি ভ*য়ে আড়ষ্ট হই,লাফিয়ে উঠি শ*ঙ্কায়। এই যেমন এখন হলো! ওনার
সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ বাড়ি। অথচ বসার ঘর মানুষজনে ভর্তি। সামান্যতম জায়গা হয়ত ফাঁকা! রাত প্রায় দশটা বাজে। এক ঘর মানুষের মধ্যে গম্ভীর চোখমুখ নিয়ে বসে আছেন বাবা আর চাচ্চুরা। তাদের ঠোঁটে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। মেজো চাচ্চুর হ*তাশ,বি*ধ্বস্ত মুখভঙ্গি। আমার বাবা যতটা গর*ম,শ্বশুর মশাই ঠিক ততটাই নরম আর শান্ত গোছের।
সূর্য ওঠে,আলো ফোটে,সকাল হয়। শুরু হয় পিউয়ের ব্যস্ততম জীবন। দশটা থেকে কলেজ,আর চারটা থেকে কোচিং। এরপরে আবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে প্রাইভেট টিউটরের এক গাদা পড়া। সামনে ধেঁয়ে আসছে এইচ- এস-সির তা*ন্ডব। ভালো রেজাল্ট চেয়ে বসে আছে সবাই। প্রত্যেকের এক কথা ‘এ -প্লাস চাই পিউ’।
আমজাদ সিকদারের মে*জাজ তুঙ্গে। ক্রমে ক্রমে ফুঁ*সছে পুরু নাকের পাটা। দাঁত কি*ড়মিড়িয়ে দোল খাচ্ছেন কেদারায়। তন্মধ্যে ঘরে ঢুকলেন মিনা বেগম। সন্তপর্ণে দোর চা*পিয়ে নরম পায়ে এগিয়ে এলেন। স্বামীর রা*গত মুখচোখে দেখে অ*তিষ্ঠ ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা দোলালেন। সুস্থে ধীরে ডাকলেন, ” শুনছেন!” আমজাদ সিকদার তাকালেন না।
সাদিফ চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে। মেঝের দিকে ভ্রুঁ গুঁটিয়ে তাকানো। তার মুখমন্ডল জুড়ে ধূসরের সুক্ষ্ম চাউনীর বিচরন। ধূসর একই কথা আবার শুধাল, ” বললি না,কত টাকা দিয়ে নিয়েছিস?” সাদিফ যথোপযুক্ত উত্তর খুঁজে পেল না। চশমা ভা*ঙা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল কী? নাহলে ধূসর কোনও দিন এভাবে জিজ্ঞেস করতে আসতোনা
আজ শুক্রবার। সাদিফ ব্যাতীত বাকিদের অবসরের দিন। ছেলেটা ছুটি পায় কেবল রবিবার৷ যেখানে পুরো বাড়িটায় এই দিন সবাই হৈহৈ করে মাতায়,সেখানে সাদিফ খা*টুনি খাঁটে অফিসে। জবা বেগমের মন খা*রাপ হয় মাঝেমধ্যে। সন্ধ্যায় সবার চায়ের আড্ডায় এইদিন সবাই যোগ দেয় যেখানে,তিনি ভীষণ ভাবে মিস করেন ছেলেকে।
পুষ্পর একটি চি*ন্তাযুক্ত সকাল আজ। মিনা বেগম প্রত্যেক দিন নামাজ পড়তে উঠে দুই মেয়ের দরজা ধা*ক্কান,নামাজের জন্যে ডাকেন। পিউ ম*রার মত ঘুমায়। টের পায়না প্রায়সই। ডাক কানে গেলে উঠে যায় অবশ্য। কিন্তু এদিক থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে পুষ্প। ধা*ক্কাতে ধা*ক্কাতে হাত খুলে গেলেও সে ওঠেনা।
পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। ধূসর ড্রাইভার হিসেবে মন্দ নয়। ভালোই চালায়। পিউ বসেছে একদম বরাবর ওর পেছনে। ধূসরের গাল ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা। পিউ খুশখুশ করল কিছুক্ষন। ভিউ মিররের কথা মনে পড়তেই চট করে তাকাল সেদিকে। ওইতো স্পষ্ট প্রতিবিম্ব ভেসে আছে ধূসরের। পিউ মুচকি হেসে চেয়ে থাকে সেদিকে।
ইকবাল, গাড়ির দরজা খুলে রেখেছে আগেই। ধূসর,পিউকে কোলে নিয়ে এসে বসাল সিটে। পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল বাইরের দিক। র*ক্ত পরা তখনও থামেনি। অথচ পিউ কা*ন্নাকা*টি করছেনা। সে ফ্যালফ্যাল করে এখনও তাকিয়ে। ধূসর পিউকে বসিয়ে নিজেও ফের হাটুভে*ঙে ওর সামনে বসে। ইকবালের বাড়িয়ে দেয়া ফার্স্ট এইডের বাক্স থেকে তুলো নিয়ে
ব্যাগ থেকে খুচরো টাকা বের করে বাদামওয়ালাকে দিলো পুষ্প। পুরনো নিউজপেপারে মোড়ানো বাদাম গুলো হাতে বয়ে বেঞ্চে বসল। কাধব্যাগটা রেখে দিলো পাশে। একটা একটা করে বাদাম ছিলে ছু*ড়ে ছু*ড়ে মুখে ভরল। ছোট খাটো পার্কের এই জায়গাটা সবচেয়ে নিরিবিলি। মানুষ জন কম আসে।
বিকেল হতে না হতেই বাড়ির গৃহীনিরা ছুটেছেন শপিং মলে। বিয়ে উপলক্ষে জমিয়ে কেনাকা*টা করবেন আজ। সাথে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন,রাদিফ আর রিক্তটাকেও। আপাতত বাড়ি শূণশাণ। সাদিফ,পিউ,পুষ্প ছাড়া কেউ নেই। আর তারা তিনজনই নিজেদের ঘরে। পিউ আজকেও উশখুশ করছে। একটু পরেই পড়াতে আসবে মারিয়া। আর সে কিছুতেই চায়না মেয়েটার কাছে
“ফোন ধরেছিলি কেন?” পিউ ভ*য়ে ভ*য়ে জানাল, ” এ..এমনি।” ” মিথ্যে বলছিস। ” ধূসরের অগাধ স্বরে পিউ ছ*টফট করে। এলোমেলো পাতা ফেলে চোখের। কী উত্তর দেবে এখন? সত্যিটা জীবন গেলেও বলতে পারবে না। ধূসর ভাই জানলে ক*বর দিয়ে দেবেন।
ধূসরের অপেক্ষা ফুরোচ্ছেনা। আর কতক্ষন বসে থাকবে এভাবে? সে বেজায় বির*ক্ত। ফোন টি*পতে টি*পতে অসহ্য লাগছে এখন। তবুও উঠে রুমে গেল না। আগে ছেলেটাকে দেখবে তারপর যাবে। এমন কোন রাজপুত্র, যাকে পিউয়ের এত্ত পছন্দ!
‘উনি? উনি কে?’ শান্তা নাজুক স্বরে জানাল ‘ ধূসর ভাই।’ হাবভাব দেখে পিউয়ের মাথা গরম হয়। নামটা বলার সময় এত লজ্জ্বা পাওয়ার কী আছে? কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, ‘ উনি কী? ভাইয়া বলতে পারিস না?’
পিউয়ের মনে বৃষ্টি নেমেছে। খড়খড়ে মরুভূমিতে ঝুমঝুম শব্দের বারিপাত,উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে ভেতরটা। প্রশান্তির হাওয়া বারেবার ছুঁচ্ছে কোমল,স্নিগ্ধ মুখমন্ডল। লজ্জ্বায় হাতদুটো জায়গা পাচ্ছে বক্ষে। হৃদস্পন্দন হচ্ছে কয়েকশ গুন বেশি৷ ধূসর ভাইয়ের এই আচরন তার কাঙ্ক্ষিত, তবে অপ্রত্যাশিত।
শীতল হুম*কিতে পিউয়ের নেত্র পল্লব কেঁ*পে ওঠে। সমস্ত দেহ ঠান্ডায় আঁটশাঁট। ধূসরের তীক্ষ্ণ,ধাঁ*রালো চাউনি হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। ধূসর রুমের চারকোনায় চোখ বোলায়। খুঁজছে কিছু। পরপর এগিয়ে যায় নাক বরাবর। দাঁড় করানো লাগেজটা হাতে তোলে।
মুখ লুকানোর জো নেই। গ্রামের চারদিকে খবর ছড়িয়েছে। যে লোক বাড়িতে এসে বলেছেন,তিনিই মুলহোতা এর। এখন কী হবে? মান ইজ্জ্বত কিচ্ছু বাকী আছে? আমজাদ সিকদার চোখ রাখলেন মেঝেতে।